Kulekhara Pata :-
খুব ছোটবেলার কথা যদি মনে করে দেখেন, তাহলে মনে পড়ে যাবে কিছু ছোট ছোট দৃশ্য। সদ্য জ্বর থেকে উঠেছে আপনার দাদা বা আপনার ঠাকুমা কষ্ট
পাচ্ছেন কিডনির স্টোন
নিয়ে।আর তখন আপনার মা বা জেঠিমা খুব স্নেহ ভরে এই রোগীদের
শুশ্রূষা করার জন্য পান করিয়ে দিচ্ছেন কুলেখাড়া
(Kulekhara) পাতার (pata) রস। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করছেন এতে রোগীদের কল্যাণ হবে। তাঁদের শরীরে
রক্ত বৃদ্ধি পাবে এবং কিডনির সমস্যার সমাধানও খুব সহজে হয়ে যাবে। আমাদের ছোটবেলায়
কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে দৌড়নর রেওয়াজ ছিল না। আর তার প্রয়োজনও ছিল না। কারণ আমাদের হেঁশেলে আর মা,
কাকিমাদের ছোট্ট নোটবুকে লেখা থাকত এমন অনেক
টোটকা যা সব রকমের মুশকিল আসান (benefits) হয়ে দাঁড়াত। রক্ত কম হলেই তাঁরা আমাদের খাইয়ে দিতেন বা বলা চলে পান করাতেন কুলেখাড়া পাতার রস। সেই
ধারা কিন্তু এখনও অব্যাহত আছে। এখনও অনেক বাড়িতে অসুস্থ রোগীকে এই পাতার রস খাওয়ানো হয়। কারণ কি জানেন?
লিভারের সুরক্ষা থেকে শুরু করে রক্তাল্পতা সব কিছু দূর করতে পারে এই পাতা। আজ
সেই নিয়েই আমাদের এই নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন।
কী-কী জরুরি উপাদান আছে
কুলেখাড়া পাতায় (Kulekhara Composition)
কুলেখাড়ার বৈজ্ঞানিক নাম হল Hygrophila
Spinose T. এটি একটি জলজ উদ্ভিদ। বিশেষত জলাভূমি বা সোয়াম্প অঞ্চলে এটি বেশি দেখা যায়।
তাই একে অনেক সময় সোয়াম্প উইডসও বলা হয়। বদ্ধ নয় এরকম জলাভুমিতেই এই উদ্ভিদ বেশি
দেখা যায়। এছাড়াও এটি জন্মায় পুকুর ও নদী সংলগ্ন এলাকায়। তবে দুঃখের কথা হল এই যে
বাড়িঘর ও শিল্প তালুক তৈরি করার জন্য এখন বেশিরভাগ জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই
এখন কুলেখাড়ার উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। নদী সংলগ্ন এলাকাতেও চাষের জন্য আগাছা ভেবে
এই উদ্ভিদ তুলে ফেলা হচ্ছে। বলা হয় যে এই গাছের আদি জন্মস্থান হল ভারত। তাই ভারতবর্ষেই
এই গাছের আধিক্য অনেক বেশি। আমাদের দেশ ভারত ছাড়াও কুলেখাড়া নামক এই জলজ উদ্ভিদ
পাওয়া যায় নেপাল, মালেশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপিন্স ও
শ্রীলঙ্কায়। কুলেখাড়া শব্দটি এসেছে ‘কোকিলাসা’ শব্দ থেকে
যার অর্থ হল কোকিলের মতো চক্ষু।এই উদ্ভিদের পাতা ও ফুলে আছে এমন কিছু ভেষজ গুণ যা
স্বাস্থ্যরক্ষায় কাজে আসে। এই উদ্ভিদে আছে অসংখ্য মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট এবং
অ্যান্টি ব্যাকটিরিয়াল উপাদান যা নানাভাবে আমাদের সাহায্য করে।তাছাড়া এতে আছে
বিশেষ কিছু অ্যালকালয়েড যেমন মিউসিলেজ, ফিক্সড অয়েল
ও খনিজ নুন।মজার বিষয় হল এই যে এই কুলেখাড়া হল এমন একটি উদ্ভিদ যার শুধু পাতা আর
কাণ্ডই কাজে আসে তা কিন্তু নয়।কাজে আসে এর বীজও। কারণ এর বীজে আছে এনজাইম, চিনি বা
গ্লুকোজ এবং সেমি ড্রাইং অয়েল।
স্বাস্থ্যরক্ষায়
কুলেখাড়া পাতার ব্যবহার (Health Benefits Of Kulekhara
Pata) :-
আমাদের দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে নানা ভাবে কুলেখাড়া পাতা খাওয়া হয়। এটি স্যালাডে এবং
শাক হিসেবেও খাওয়া হয়। কারণ প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী এই গাছের পাতার গুনাগুণ আমাদের কারো অজানা নয়। কীভাবে আমাদের কাজে আসে
কুলেখাড়া পাতা সেটা আমরা দেখে নেব।
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে (Helps
To Prevent Anemia)
কুলেখাড়া গাছের পাতা ও কাণ্ড অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে। এই গাছের পাতা ও কাণ্ড
খেলে বা সেটার রস পান করলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।এই বিষয়টি
আয়ুর্বেদে উল্লেখ করা থাকলেও আধুনিক জুগেও এটি বহু রোগীর উপর গবেষণা করে দেখা
হয়েছে। যারা অ্যানিমিয়া বা রকাল্পতায় ভোগেন দেখা গেছে তাঁরা কুলেখাড়া পাতা খেলে
তাঁদের শরীরে হিমোগ্লোবিন ও হোয়াট ব্লাড সেল দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্লিডিং আলসার দূর করে (Treats
Bleeding Ulcer)
কিছু ধরনের আলসার থাকে, যার ক্ষত বা ঘা এতটাই খারাপ
পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে সেখান থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করে। অনেক সময় এই রক্ত ক্ষরণ
শরীরের ভিতরে হয় বলে আমরা বুঝতেও পারিনা কিন্তু অজান্তেই শরীরের অনেক ক্ষতি হয়ে
যায়। কুলেখাড়া এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করে দিতে সক্ষম। তাছাড়া রক্ত বেরনোর জন্য আপনার
যেটুকু ব্লাড লস হয়েছে সেটাও পূরণ করে দেয় এই পাতা।
লিভার বা পাকস্থলীর সুরক্ষা দেয় (Protects
Liver)
শুধু শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না এই পাতা। আপনার লিভারের
সুরক্ষাও প্রদান করে। বিশেষ করে খাওয়ার হজম করাতে কুলেখাড়া পাতা কাজে দেয় কারণ এতে
আছে বেশ কিছু পাচক বা এনজাইম। এছাড়াও লিভার বা পাকস্থলী যাতে নিজের কাজ ঠিকঠাক
করতে পারে সেটাও লক্ষ্য রাখে এই পাতা।
কিডনির পাথর ভেঙে দেয় ও গলিয়ে দেয় (Helps
To Dissolve Kidney Stones)
যারা কুলেখাড়া পাতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না, তাঁদের বলি, রক্তে
হিমোগ্লোবিনের পরেই যদি আর কোনও কারনে এই পাতার ব্যবহার সর্বাধিক হয়ে থাকে তাহলে
সেটা হল কিডনির স্টোন বা পাথর দূর করতে।এই উদ্ভিদে যে এনজাইম আছে তা কিডনির ভিতরে
জমে থাকা স্টোন বা পাথর ভেঙে প্রথমে ছোট করে দেয়। তারপর সেটা ধীরে ধীরে গলিয়ে দিতে
শুরু করে। এটা শরীর থেকে মল বা মূত্র রূপে বেরিয়ে আসে।
শরীরের কোষে পুষ্টি যোগায় (Rich
Source Of Nutrition)
কোষের সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তা আছে কুলেখাড়া পাতায়। এর মধ্যে
আছে প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এর মধ্যে আছে আরও অনেক ক্ষারীয় উপাদান। এছাড়া
আছে এমন কিছু খনিজ নুন যা কোষের বিকাশের জন্য দরকার। তাই এই পাতা মাঝে মাঝে বা
নিয়মিত খেলে শরীরের কোষে সঠিক পুষ্টি সরবরাহ হয়।
শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে (Increase
Your Strength)
শরীরের প্রতিটি কোষ যখন পুষ্টি পায় তখন এটা খুবই স্বাভাবিক যে আমাদের শারীরিক
শক্তিও তার সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। কুলেখাড়া ঠিক সেই কাজটি খুব যত্নের সঙ্গে করে। রক্তে
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে এটি রক্ত পরিশ্রুতও করে। সব মিলিয়ে
দেখা গেছে যে এটি নিয়মিত খেলে বা এর রস পান করলে আমাদের এনার্জি অনেকটাই বেড়ে যায়।
জননতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে (Take
Care Of Your Uterus)
যেসব মহিলারা সদ্য মা হয়েছেন তাঁদের জন্য এবং আমাদের জননতন্ত্র ও যৌনাঙ্গকে
মজবুত ও আরও উন্নত করে এই পাতা। অনেকে বিশ্বাস করেন এই পাতা ও তার কাণ্ড ফুটিয়ে
সেদ্ধ করে সেই জল পান করলে মাতৃত্বকালীন যে অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের সমস্যা হয় সেটা
কমে যায়। আসলে এই পাতার মধ্যে সেই গুণ আছে যা রক্তক্ষরণ রোধ করতে সক্ষম।
কী কী ভাবে এই
কুলেখাড়া পাতা ব্যবহার করবেন (Kulekhara Pata Uses)
:-
এই পাতা আপনি
নানা রূপে এবং নানা ভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এই গাছের কাণ্ড, পাতা, মূল ও বীজ সবটাই
ব্যবহার করা যায়। যদি সরাসরি এই উদ্ভিদ আপনি গ্রহণ করতে চান তাহলে তিনটি উপায়ে
করতে পারেন। কাঁচা পাতা স্যালাডে খেতে পারেন, এই পাতা ও
কাণ্ডের রস খেতে পারেন বা এই শাক রান্না করে খেতে পারেন। যদি সরাসরি খেতে আপনার
কোনও সমস্যা বা অসুবিধে হয় তাহলে আপনি কুলেখাড়ার টনিক, কুলেখাড়ার
পাউডার, কুলেখাড়ার ট্যাবলেটও খেতে
পারেন।যাঁদের চোখে সমস্যা আছে বিশেষ করে কর্নিয়ার আলসারে যারা ভুগছেন তাঁরাও এই
পাতা ব্যবহার করতে পারেন। তাঁরা এই গাছের পাতা আর কাণ্ড পুড়িয়ে তার থেকে যে ধোঁয়া
বেরোয়, তার সামনে বসতে হয়। বিশ্বাস করা
হয় যে এই কুলেখাড়া গাছের পাতা পুড়িয়ে যে ধোঁয়া বেরোয় সেটা চোখে গেলে এই কর্নিয়ার
আলসার সেরে যায়।
কুলেখাড়া পাতার
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া (Kulekhara Side-effects) :-
যে কোনও বস্তুরই ভাল এবং মন্দ
দুটো দিকই থাকে। কুলেখাড়া পাতার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাই এর ভাল দিকগুলো
বিচার করার সঙ্গে সঙ্গে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ঠিক কীরকম হতে পারে সেটা জেনে
নেওয়া দরকার আছে।তবে যেহেতু এটি একটি ভেষজ উদ্ভিদ বা মেডিসিনাল প্লান্ট তাই বহু
যুগ ধরে এর ব্যবহার আমাদের দেশে চলে আসছে। এখনও পর্যন্ত এই পাতা সেবনের ফলে
সাঙ্ঘাতিক কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। যদিও বা সামান্য কিছু
হয়ে থাকে সেটা খুবই সাধারণ। তবে তা স্বত্তেও আমাদের কিছু ক্ষেত্রে একটু সাবধান
হওয়া ভাল।
যখন আপনি শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান
করাচ্ছেন, যখন আপনি সন্তান ধারণের
পরিকল্পনা করছেন এবং যখন আপনি ছয় মাসের উপর গর্ভবতী তখন কুলেখাড়া পাতা না খাওয়াই
ভাল। যদি সেটা ট্যাবলেট বা টনিক রূপে আপনি খেতে চান তাহলে সেটা আপনার ডাক্তার
আপনাকে বলবেন। আপনি নিজে থেকে কিছু করতে যাবেন না। এছাড়া আপনার যদি ক্রনিক কোনও
অ্যালার্জির সমস্যা থাকে তাহলে এটা খাবেন না। যাঁরা হাইপারসেন্সিটিভ তাঁদেরও এই পাতা
এড়িয়ে ছইলা উচিত। যেহেতু এই পাতা জলজ তাই খেয়াল রাখতে হবে যে জলজ কোনও শাকপাতা
খেলে আপনার কোনও সমস্যা হয় কিনা। যদি উত্তর হ্যাঁ হয় সরাসরি এই পাতার রস আপনার পান
না করাই ভাল।
কুলেখাড়া
পাতা নিয়ে কিছু জরুরি প্রশ্নোত্তর (FAQs)
:-
১। প্রশ্ন: গর্ভবতী মহিলারা কি কুলেখাড়া পাতা ব্যবহার করতে পারে?
উত্তর: প্রথমে
দেখতে হবে এটা আদৌ তাঁদের প্রয়োজন আছে কিনা। যদি গর্ভবতী অবস্থায় রক্তাল্পতার
সমস্যা একজন হবু মায়ের থাকে তাহলে কুলেখাড়া পাতা সে খেতে পারে। যদি না তার
ডাক্তারের কোনও বারণ থেকে থাকে। সরাসরি এই পাতা গ্রহণ করায় কোনও সমস্যা থাকলে
কুলেখাড়া পাতার টনিক বা ট্যাবলেটও খাওয়া যায়। যেহেতু গর্ভবতী মায়ের সঙ্গে শিশুর
ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে তাই একবার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত।
২। প্রশ্ন: শিশুকে যে মা মাতৃদুগ্ধ পান করাচ্ছেন তিনি কি কুলেখাড়া পাতা ব্যবহার করতে পারেন?
উত্তর: শিশুর
জন্মের পর অনেক মাই রক্তাল্পতায় ভোগেন। কিনা।সন্তানের জন্মের পর মহিলাদের আবার
ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যায়। আর নয় মাস ঋতুস্রাব বন্ধ থাকার দরুন একটু বেশিই ব্লাড ফ্লো
হতে থাকে। সেক্ষেত্রে সদ্য একজন মায়ের পক্ষে অতিরিক্ত ব্লাড লস মোটেই ভাল নয়। তাই
তাঁরা কুলেখাড়া পাতার রস পান করেন। যদি এই নিয়ে মনে কোনও সন্দেহ থাকে তাহলে একবার
ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নিয়ে নেবেন।
৩। প্রশ্ন: খালি পেটে কি কুলেখাড়া পাতার রস খাওয়া যায়?
উত্তর: অনেকেই আছেন
যারা খালি পেটে সকাল বেলা উঠে এই পাতার রস পান করেন। এখনও পর্যন্ত তাঁদের বিশেষ
কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে কিছু না খেয়ে এই পাতার রস পান করলে গা
গুলোতে পারে। সেক্ষেত্রে হাল্কা কিছু খেয়ে তারপর এটা খেতে পারেন।
৪। প্রশ্ন: কুলেখাড়া পাতা কথায় সুরক্ষিত ভাবে রাখা যাবে?
উত্তর: রুম
টেম্পারেচারে সূর্য রশ্মির থেকে দূরে এটা রাখা ভাল। ফ্রিজে এই পাতা না রাখাই ভাল।
তাহলে গুণ নষ্ট হয়ে যাবে।
৫। প্রশ্ন: আমি কি প্রতিদিন কুলেখাড়া পাতার রস পান করতে পারি?
উত্তর: সেটা নির্ভর
করবে আপনার ঠিক কীরকম শারীরিক সমস্যা আছে তার উপর। তবে কোনও কিছুই অতিরিক্ত ভাল
নয়। সেক্ষেত্রে একবার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
No comments:
Post a Comment